এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়

নরসিংদী অঞ্চলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নরসিংদী নগরের রূপকার তৎকালীন সাটিরপাড়ার জমিদারি তালুকদার ললিতমোহন রায় তাঁর বাবার নামে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট’ ইংরেজি বিদ্যালয়। ফলে এই অঞ্চলে শিক্ষার যে-দ্বার উন্মোচন হয়েছিলো, তার ঠিক দুই বছর পর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠা পায় আরেকটি ইংরেজি বিদ্যালয়, যার নাম ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ (বর্তমান নাম রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি শুরু থেকেই আলোড়ন তুলেছিলো এন্ট্রান্স পরীক্ষার সাফল্যে। সমসময়ে গড়ে ওঠা সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট এবং রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট— বিদ্যালয় দুটি নরসিংদী অঞ্চলে শিক্ষার যে-নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলো এবং এখনো যে-আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

নরসিংদীর বরেণ্য লেখক ও গবেষকেরা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বহু তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ কিংবা নিবন্ধ লিখেছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এবং আমি অত্যন্ত অবাক হয়েছি এই কারণে যে, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের লেখা ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’সহ ইতিহাসের অন্যান্য গ্রন্থ ও গবেষণায় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে আরো স্বনামধন্য শতবর্ষী বিদ্যালয়ের নাম-ইতিহাস থাকলেও রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। হয়তো সঠিক তথ্যের অভাব কিংবা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রায়পুরার তাত্তাকান্দা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাজকিশোর পাল চৌধুরী এবং হাসিমপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাধামোহন পাল চৌধুরী দুজনের নামের প্রথম অংশ নিয়ে ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ নামে এ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি রায়পুরার কুড়েরপাড় নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। সংক্ষেপে একে ‘আর কে আর এম’ বলা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়টির প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী নলিনী ঘোষ। তাঁর বাড়ি ছিলো কলকাতায়। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।

উল্লেখ্য যে, রায়পুরারই আরেক শতবর্ষী শিক্ষালয় আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র শিক্ষক আমার নানা মরহুম মৌলভী আমির উদ্দিন আহমেদ নরসিংদী অঞ্চলের সর্বপ্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে এন্ট্রান্স পাশের গৌরব অর্জন করেছিলেন কলকাতা মাদরাসা থেকে। একটি ডায়েরিতে তাঁর কিছু ছাত্রের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার রেজাল্ট ও সন-তারিখ লেখা ছিলো। সেখান থেকেই এসব ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। তৎসময়কার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তথ্য, বিদ্যালয়ের ইতিহাস জানার চেষ্টা থেকে আমি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল বের করি, যা ছিলো খুবই দুঃসাধ্য ও কঠিন একটি কাজ। আর এই কাজে আমি দিক-নির্দেশনা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিকের নিকট থেকে, যিনি এসব বিষয়ে বিশদ গবেষণা করছেন।

রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তখনকার সময় বিদ্যালয়টি কতোটা স্বনামধন্য ছিলো। এমনকি সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে যেন এক ধরনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিলো। এ-পর্যায়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯০৭-১৯০৯ সালের এন্ট্রান্স পরীক্ষা এবং ১৯১০-১৯১৩ ও ১৯১৫-১৯২০ সালের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের সাফল্যের স্বরূপ তুলে ধরবো।

এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৭
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : রজনী কান্ত দত্ত (১৯ বছর ১ মাস) এবং তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অভয়চরণ ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৫ মাস)।

এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৮
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৭ মাস), অম্বিকাচরণ (১৬ বছর ৬) ও উপেন্দ্র নারায়ণ কারকুন (১৮ বছর ১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৭ বছর ৯ মাস)।

এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : ক্ষিতিশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৬ বছর ৮ মাস) ও যোগেন্দ্র চন্দ্র নাথ (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : পূর্ণচন্দ্র দত্ত (১৯ বছর ২ মাস) ও নবদ্বীপ চন্দ্র সাহা (১৬ বছর ১০ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নরেন্দ্রচন্দ্র দাস (১৭ বছর ১১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আলা উদ্দিন ভূঁইয়া (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নাছির উদ্দিন (১৯ বছর ২ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১১
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজমোহন দাস (১৬ বছর ৮ মাস) ও গঙ্গাচরণ সাহা (১৮ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তমিজাদ্দিন (২০ বছর ২ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অখিল চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১০ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১২
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : চন্দ্র কিশোর দে (২০ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : নূরাহাদ ভূঁইয়া (১৮ বছর ২ মাস) ও মথুচন্দ্র পাল (২০ বছর)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ১০ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৩
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল হাকিম (১৬ বছর ১১ মাস), আব্দুল মজিদ (১৮ বছর), মনমোহন ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৯ মাস), নকুল চন্দ্র দাস (১৮ বছর ৮ মাস), ভুপেন্দ্র চন্দ্র কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস) ও অক্ষয় কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ২ মাস), আব্দুল গণি (১৭ বছর ৩ মাস), মদন মোহন ভট্টাচার্য (২১), জনাব আলী (১৯ বছর ২ মাস), অধর চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১১ মাস) ও পূর্ণ চন্দ্র পাল (১৮ বছর ৪ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৫
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তায়েব উদ্দিন (১৬ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : শামসুল হক (১৭ বছর ২ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৬
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৭ বছর ৪ মাস) ও হরেন্দ্র লাল পাল (১৭ বছর ৫ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : গঙ্গা চন্দ্র বিশ্বাস (২১ বছর ৫ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৭
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : আহম্মেদ আলী (১৭ বছর ৪ মাস) ও সুরেশ চন্দ্র দাস (১৭ বছর ৫ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : আব্দুর রহমান মিয়া (২৩ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৮ বছর ৯ মাস) ও উপেন্দ্র কিশোর দত্ত (২২ বছর ১১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : সচীন্দ্র লাল কর্মকার (১৭ বছর ১১ মাস), মোহাম্মদ জনাব আলী (১৬ বছর ৫ মাস) ও যতীন্দ্র কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৮
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মো. ইমদাদুল হক (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : বশির উদ্দিন আহম্মেদ (১৯ বছর ৫ মাস) ও ইন্দ্র মোহন দাস (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মনমোহন সাহা (১৮ বছর ২ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৪ জন : ললিত কুমার দত্ত (২১ বছর ১ মাস), পরেশ চন্দ্র নাগ (১৭ বছর ২ মাস), সোনা মিয়া (১৬ বছর ১১ মাস) ও রজনীকান্ত তালুকদার (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১১ জন : আব্দুল গফুর ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস), আব্দুর রহমান (১৭ বছর ৩ মাস), আব্দুস সোবহান (১৭ বছর ১১ মাস), হিরেন্দ্র কুমার দাস (২০ বছর ৩ মাস), অশ্বিনী কুমার গোস্বামী (২০ বছর ৪ মাস), জলধর কর্মকার (১৭ বছর), মুহাম্মদ সাহেব আলী (২০ বছর ৫ মাস), সুরেশ চন্দ্র পাল (১৭ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ২ মাস), সফিউদ্দিন ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস) ও ক্ষেত্র মোহন সাহা (২১ বছর ৭ মাস)।

মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯২০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : হরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ (১৭ বছর ১০ মাস) ও ভরত চন্দ্র নাথ (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৭ জন : আব্দুল আজিজ (১৮ বছর ১১ মাস), আব্দুল ওয়াহেদ (১৮ বছর ১০ মাস), ললিত মোহন দাস (২১ বছর ৫ মাস), অমর চন্দ্র পাল (২০ বছর ৪ মাস), অশ্বিনী কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস), নগেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ৪ মাস) ও অনন্ত কুমার শ্যাম (২২ বছর ৩ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : মুহাম্মদ নওয়াব আলী (১৭ বছর ২ মাস) ও মনিরউদ্দিন (১৮ বছর ৯ মাস)।

উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সালে এই বিদ্যালয় থেকে প্রথম ২ জন মুসলমান ছাত্র মেট্রিকুলেশন পাশ করে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং অতি অল্প সময়ে আশানুরূপ ফলাফলে দ্রুত শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেতে থাকে। রায়পুরা ছাড়াও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রী এসে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে এক পর্যায়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের জন্যে আবাসিক বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬২ সালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কুড়েরপাড় থেকে তাত্তাকান্দায় মেঘনা নদীর শাখা কাঁকন নদীর তীরে পাগলনাথ মন্দিরের পাশে ৩ একর ৮১ শতাংশ জায়গায় গড়ে তোলেন বিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস। ১২০ বছরের পুরোনো রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়টি সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এটাই কাম্য।


তথ্যসূত্র
১. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্যালেন্ডার (১৯০৮-১৯২৩) ও
২. কাঁকন, বিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন।


খন্দকার পারভেজ আহম্মদ (পিনু)
আহ্বায়ক, আমরা হাজীপুর ইউনিয়নবাসী

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ